নিজস্ব প্রতিবেদক:: ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারানো ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম অবশেষে ফিরে এলেন প্রিয় শহর রাজশাহীতে—তবে জীবিত নয়, কফিনবন্দি হয়ে। বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে আসা তৌকিরের মরদেহ বহন করা ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স থামলে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসেন স্বজনেরা। বাবার বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে, মায়ের ডুকরে উঠা আহাজারি ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। সবার চোখে তখন শুধুই কান্না আর শোকের ছবি।
মঙ্গলবার বিকেলে রাজশাহীর সপুরা গোরস্তানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয় তরুণ পাইলট তৌকির ইসলামকে। এর আগে বিকেল সাড়ে চারটায় রাজশাহী জেলা মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জানাজায় মানুষের ঢল নামে। বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান, সাবেক সিটি মেয়র মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেনসহ সামরিক ও বেসামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, সহকর্মী, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন এবং সর্বস্তরের মানুষ তৌকিরকে শেষ বিদায় জানাতে আসেন।
জানাজার আগে তৌকিরের সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করা হয়। এরপর বাবার পরিচিত কণ্ঠ হঠাৎ কেঁপে ওঠে। তৌকিরের বাবা তহুরুল ইসলাম কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন,
‘আমি সেই হতভাগ্য পিতা, যে নিজের সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়েছি। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যেন ওকে জান্নাত দান করেন। আপনারা সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন।’
কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় নিহত অন্যদের জন্যও দোয়া চান।
মরদেহবাহী হেলিকপ্টারটি বেলা ২টা ৫৫ মিনিটে রাজশাহী সেনানিবাসে পৌঁছালে তৌকিরকে সালাম জানিয়ে শেষ সম্মান জানানো হয়। এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নগরের উপশহরের ভাড়া বাসায়। লাশবাহী গাড়ির পাশে ছেলের ছবি বুকে চেপে কান্নায় ভেঙে পড়েন তৌকিরের মা। ‘আমার তৌকিরকে দাও, আমার ছেলেটাকে একটু ছুঁয়ে দেখি’—কান্নার এ শব্দ বাতাস ভারি করে তোলে। ছোট-বড়, পাশের বাসার মানুষ, বন্ধু, পরিচিত জনেরা ছুটে এসে চোখের জল মুছতে মুছতে শেষবার প্রিয় মানুষটিকে দেখে নেন।
রাজশাহীতেই বেড়ে ওঠা তৌকিরের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে হলেও পরিবার নিয়ে ২৫ বছর ধরে রাজশাহীতে ছিলেন তার বাবা তহুরুল ইসলাম। একমাত্র ছেলে তৌকির রাজশাহীর ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে পাবনা ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। ২০১৪ সালে এসএসসি ও ২০১৬ সালে এইচএসসি পাস করার পর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগ দেন তৌকির ইসলাম।
বছরখানেক আগে বিয়ে করা তৌকিরের স্ত্রী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক। বিয়ের পরে নতুন স্বপ্ন বুনছিলেন তারা। তরুণ তৌকিরের স্বপ্ন ছিল আকাশ ছুঁয়ে দেখার, দেশ রক্ষায় বিমান উড়িয়ে আকাশ পাহারা দেওয়ার। সোমবার সেই স্বপ্নের দিন ছিল তার জীবনে—প্রশিক্ষণের শেষ ধাপ, একা যুদ্ধবিমান উড়ানোর দিন। আকাশে নিজের প্রথম সলো উড্ডয়নের দিনটি একজন পাইলটের কাছে সবচেয়ে গর্বের দিন। কিন্তু সেই দিনই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় শেষ হয়ে যায় তৌকিরের জীবনের সমস্ত সম্ভাবনা।
সোমবার সকালে রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর আছড়ে পড়ে যুদ্ধবিমানটি। তৌকিরের প্রাণ ঝরে যায় সেই দুর্ঘটনায়। এ ঘটনায় স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ এখন পর্যন্ত ৩২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তৌকিরের মৃত্যুতে তার পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া, আর পুরো এলাকায় নেমে এসেছে শোকের মাতম।
তৌকির ইসলাম আকাশ ছুঁতে চেয়েছিলেন, সেই আকাশেই হারিয়ে গেলেন চিরতরে। এখন তিনি শুয়ে আছেন প্রিয় শহর রাজশাহীর মাটিতে, আর তার পরিবারসহ পুরো দেশ তাঁকে মনে রাখবে সাহসী পাইলট হিসেবে।