সীমান্তের খবর ডেস্ক: দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ভারত এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে বহুল আলোচিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) অবশেষে সই হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার পর এটি যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য চুক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর লন্ডন সফরের সময় বৃহস্পতিবার এই চুক্তির ঘোষণা দেন উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী—ভারতের নরেন্দ্র মোদী এবং যুক্তরাজ্যের স্যার কিয়ের স্টারমার। দুই নেতাই এই চুক্তিকে দুই দেশের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।
কী থাকছে এই চুক্তিতে?
এই চুক্তি কার্যকর হলে ভারতীয় পোশাক, জুতা, গয়না, মশলা, সিফুড এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য যুক্তরাজ্যের বাজারে সহজলভ্য হবে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের তৈরি গাড়ি, হুইস্কি, বিমানযন্ত্রাংশ এবং অন্যান্য পণ্য ভারতীয় বাজারে সুলভে পাওয়া যাবে। দুই দেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমানে যুক্তরাজ্য তার মোট রফতানির ১.৯ শতাংশ ভারতে রফতানি করে এবং ভারত থেকে মোট আমদানির ১.৮ শতাংশ গ্রহণ করে। ২০২৪ সালে দুই দেশের মধ্যে ৪০ বিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি পণ্য ও সেবার লেনদেন হয়েছে। যুক্তরাজ্যের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের আমদানি চাহিদা বেড়ে ২.৮ ট্রিলিয়ন পাউন্ডে পৌঁছাবে, যা তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার।
শুল্ক কমানোর সুযোগ
চুক্তির আওতায় যুক্তরাজ্য থেকে আসা পণ্যের ওপর ভারতের গড় শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হবে। হুইস্কির ক্ষেত্রে ১৫০ শতাংশ শুল্ক ধাপে ধাপে কমিয়ে প্রথমে ৭৫ শতাংশ এবং এক দশকের মধ্যে ৪০ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো ভারতে তাদের পণ্য সহজে বাজারজাত করতে পারবে।
বড় চুক্তি ও বিনিয়োগ
এই চুক্তির অধীনে এয়ারবাস এবং রোলস রয়েসের সঙ্গে প্রায় ৫০০ কোটি পাউন্ডের চুক্তি হয়েছে, যা ভারতের কাছে বিমান এবং ইঞ্জিন সরবরাহে কাজে আসবে।
ভারত ও যুক্তরাজ্য উভয়ের জন্য লাভ
এই চুক্তির ফলে যুক্তরাজ্যের গাড়ি, অ্যারোস্পেস পণ্য, মেডিকেল যন্ত্রপাতি, হুইস্কি, মাংস, চকোলেট ও বিস্কুট ভারতের বাজারে সস্তায় পাওয়া যাবে। অন্যদিকে, ভারতীয় গয়না, রত্ন, সিফুড এবং পোশাক যুক্তরাজ্যে প্রতিযোগিতামূলক দামে পৌঁছাবে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্টারমার জানিয়েছেন, চুক্তির ফলে যুক্তরাজ্যে প্রায় ২,২০০ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। ভারতের দিক থেকে এই চুক্তি রফতানি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে এবং অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে।
কার্বন কর নিয়ে উদ্বেগ
চুক্তির অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো যুক্তরাজ্যের কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট, যা আগামী বছর থেকে চালু হতে যাচ্ছে। এই কর ভারতীয় রফতানি পণ্যকে প্রভাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে ভারতীয় রফতানি পণ্যগুলোর খরচ কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে।
দীর্ঘ আলোচনার পর বাস্তবায়ন
২০২২ সালে বরিস জনসনের সময় চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও তা থেমে ছিল। পরে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয় এবং মে মাসে চূড়ান্ত আলোচনা শেষ হয়। অবশেষে মোদীর যুক্তরাজ্য সফরের সময় বৃহস্পতিবার এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
কিয়ের স্টারমার এই চুক্তিকে “যুগান্তকারী মুহূর্ত” বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং জানিয়েছেন, এটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার পর যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চুক্তি। মোদী এই চুক্তিকে দুই দেশের “অভিন্ন সমৃদ্ধির নকশা” হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ভারতের ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিক্রিয়া
ভারতের ব্যবসায়ী মহল এবং শিল্প সংস্থাগুলো এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। মাহিন্দ্রা গ্রুপের সিইও ড. অনীশ শাহ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এই চুক্তি বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। এটি সরবরাহ শৃঙ্খলকে মজবুত করবে, প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াবে এবং স্বল্প-কার্বন অর্থনীতিকে উৎসাহিত করবে।”
টিভিএস সাপ্লাই চেইন সলিউশনসের চেয়ারম্যান আর দীনেশ বলেছেন, “এই চুক্তি বাণিজ্যিক জটিলতা কমাবে, আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় কোম্পানির অবস্থান শক্ত করবে এবং বিনিয়োগের সুযোগ বাড়াবে।”
তবে যুক্তরাজ্যের কিছু বিরোধী রাজনৈতিক দলের দাবি, ভারতীয় পেশাজীবীদের জন্য চাকরির সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে ব্রিটিশ কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যমন্ত্রী এই আশঙ্কাকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ গীতাঞ্জলি সিনহা রায় বলেছেন, “এই চুক্তি দুই দেশের জন্যই লাভজনক, কারণ এতে শুল্কে শিথিলতা এনে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতীয় টেক্সটাইল, সিফুড এবং গয়না রফতানি ক্ষেত্রে সুবিধা পাবে।”
তিনি আরও বলেন, “উপকূলীয় অঞ্চলে সিফুড রফতানি বৃদ্ধি পেলে সেই এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন হবে এবং স্থানীয় নারীদের কাজের সুযোগ তৈরি হবে। গয়না শিল্পের ক্ষেত্রেও নতুন প্রজন্ম আগ্রহী হবে।”
মানব রচনা ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক উপমন্যু বসু এই চুক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বলেছেন, “যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পর এটি প্রথম বৃহৎ চুক্তি। তবে জলবায়ু ইস্যুতে স্পষ্টতা না থাকায় কিছু বিষয়ে ভবিষ্যতে নজর রাখতে হবে।”
অর্থনীতিবিদ মিত্রায়ু দাশগুপ্ত মনে করেন, “ট্রাম্পের সঙ্গে বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে ভারতের দরকষাকষির সময় এই চুক্তি ভারতের দৃঢ় অবস্থানের প্রমাণ।”
উপমন্যু বসুর মতে, “এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত পদক্ষেপ, যা ভারতের বৈশ্বিক অবস্থানকে আরও শক্ত করবে।” তথ্যসূত্র: বিবিসি