সীমান্তের খবর ডেস্ক: ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার—দিনটি চিরকাল যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের ইতিহাসে এক কালো দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। সেদিন একযোগে চারটি যাত্রীবাহী জেট বিমান ছিনতাই করে সেগুলোকে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ব্যবহার করা হয়। নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ ভবনে সেগুলো আঘাত হানে, যাতে প্রায় তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারান। ঘটনাটি শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দেয়।
হামলার ধরন ও লক্ষ্যবস্তু
আল-কায়েদার পরিকল্পনা অনুযায়ী, ছিনতাইকারীরা পূর্ব আমেরিকার আকাশপথ থেকে একসাথে চারটি বিমান নিয়ন্ত্রণে নেয়। এরপর সেগুলো ব্যবহার করা হয় আমেরিকার শক্তি ও প্রতীকের ওপর আঘাত হানতে।
স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৪৬ মিনিটে প্রথম বিমানটি গিয়ে ধাক্কা মারে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নর্থ টাওয়ারে।
মাত্র ১৭ মিনিট পর, সকাল ৯টা ৩ মিনিটে, আরেকটি বিমান গিয়ে আঘাত হানে সাউথ টাওয়ারে।
দুটি ভবনেই আগুন ধরে যায়, ধোঁয়ায় আকাশ ঢেকে যায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১১০ তলা বিশাল টাওয়ার দুটি ভেঙে পড়ে, শহরকে গ্রাস করে ধূলিঝড়।
এদিকে সকাল ৯টা ৩৭ মিনিটে তৃতীয় বিমানটি আঘাত হানে ওয়াশিংটনের উপকণ্ঠে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগনের পশ্চিমাংশে।
অন্যদিকে সকাল ১০টা ৩ মিনিটে চতুর্থ বিমানটি বিধ্বস্ত হয় পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে। ধারণা করা হয়, এই বিমানটির লক্ষ্য ছিল ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল ভবন। তবে যাত্রীরা ছিনতাইকারীদের প্রতিরোধ করে সেটিকে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেয়নি।
প্রাণহানি ও হতাহতের বিবরণ
মোট ২,৯৭৭ জন নিহত হন (১৯ ছিনতাইকারী বাদে)।
চারটি বিমানের যাত্রী ও ক্রু—২৪৬ জন
টুইন টাওয়ারে তাৎক্ষণিক ও পরে প্রাণহানি—২,৬০৬ জন
পেন্টাগনে নিহত—১২৫ জন
সবচেয়ে ছোট বয়সী নিহত ছিল মাত্র দুই বছরের শিশু ক্রিস্টিন লি হ্যানসন, বাবা-মায়ের সঙ্গে সে বিমানে ছিল। আর প্রবীণ নিহত ছিলেন ৮২ বছরের রবার্ট নর্টন, যিনি স্ত্রীকে নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন।
প্রথম বিমানটি যখন নর্থ টাওয়ারে আঘাত করে, ভবনের ভেতরে আনুমানিক ১৭ হাজার ৪০০ জন মানুষ ছিলেন। আঘাতের উপরের তলায় কেউই জীবিত বের হতে পারেননি। তবে সাউথ টাওয়ারে যেখানে দ্বিতীয় বিমানটি ধাক্কা মারে, সেখান থেকে ১৮ জন বের হতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শুধু আমেরিকান নয়, নিহতদের মধ্যে ৭৭টি দেশের নাগরিক ছিলেন। এছাড়া নিউইয়র্কে উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া দমকলকর্মী, পুলিশ ও চিকিৎসা কর্মীদের মধ্যে ৪৪১ জন নিহত হন। আরও হাজারো মানুষ আহত হন, যাদের অনেকেই দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসকষ্ট, ক্যানসারসহ নানা জটিলতায় আক্রান্ত হন।
হামলাকারীরা কারা ছিল?
মার্কিন তদন্তে জানা যায়, এই হামলার পরিকল্পনা করেছিল উগ্রপন্থী সংগঠন আল-কায়েদা। সংগঠনটির নেতা ওসামা বিন লাদেন মুসলিম বিশ্বের সংঘাত ও ক্ষোভকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন।
মোট ছিনতাইকারী ছিলেন ১৯ জন।
তাদের মধ্যে ১৫ জন সৌদি আরবের নাগরিক।
বাকিদের মধ্যে দুজন আমিরাতের, একজন মিশরের এবং একজন লেবাননের।
প্রতিটি দলে একজন করে পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল। এরা কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লাইট স্কুল থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও আফগানিস্তান যুদ্ধ
ঘটনার এক মাসেরও কম সময় পর প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালান। লক্ষ্য ছিল আল-কায়েদাকে নিশ্চিহ্ন করা এবং ওসামা বিন লাদেনকে ধরিয়ে দেওয়া। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও কয়েকটি মিত্র দেশ অংশ নেয়।
বছরের পর বছর যুদ্ধ চলতে থাকে। অবশেষে ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অভিযানে ওসামা বিন লাদেন নিহত হয়।
এদিকে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত খালিদ শেখ মোহাম্মদ ২০০৩ সালে পাকিস্তানে গ্রেফতার হন। তাকে এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুয়ান্তানামো বে কারাগারে বিচারাধীন রাখা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তার পরিবর্তন
৯/১১ হামলার পর বিমান ভ্রমণের নিরাপত্তায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে গঠিত হয় ট্রান্সপোর্টেশন সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (TSA), যা বিমানবন্দর ও বিমানের নিরাপত্তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। আজও বিশ্বজুড়ে বিমান ভ্রমণে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কড়াকড়ির মূল কারণ এই হামলা।
ধ্বংসস্তূপ থেকে স্মৃতিসৌধ
নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারের ধ্বংসস্তূপ সরাতে সময় লেগেছিল আট মাসেরও বেশি। সেই স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর। একই স্থানে নির্মিত হয়েছে ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বা “ফ্রিডম টাওয়ার”, যার উচ্চতা ১,৭৭৬ ফুট—আগের নর্থ টাওয়ারের তুলনায়ও উঁচু।
পেন্টাগন ভবনও দ্রুত পুনর্গঠন করা হয়। ২০০২ সালের আগস্টের মধ্যেই কর্মীরা তাদের অফিসে ফিরতে সক্ষম হন।
বিশ বছর পরেও প্রভাব
হামলার দুই দশক পরও এর প্রভাব বিশ্ব রাজনীতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিদ্যমান। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করলেও আশঙ্কা রয়ে গেছে যে, আল-কায়েদা বা অন্যান্য উগ্র গোষ্ঠী আবারও সেখানে ঘাঁটি গেড়ে উঠতে পারে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শুধু আমেরিকানদের নয়, পুরো পৃথিবীর জন্যই একটি দুঃখ ও শোকের দিন হয়ে আছে। সেই ভয়াবহ হামলা দেখিয়ে দিয়েছিল সন্ত্রাসবাদের পরিণতি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে এবং নিরাপত্তার প্রতি উদাসীনতা কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তথ্যচিত্র: বিবিসি