সীমান্তের খবর ডেস্ক : গাজায় চলমান যুদ্ধ থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রায় দিয়েছে হামাস। গোষ্ঠীটি জানিয়েছে, তারা “পুরোপুরি প্রস্তুত আলোচনা শুরু করতে”, তবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিছু “সংশোধনের প্রস্তাব” করেছে।
ফিলিস্তিনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, হামাস প্রস্তাবের সামগ্রিক কাঠামো মেনে নিলেও কিছু নিরাপত্তা ও মানবিক দিক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নিশ্চিত গ্যারান্টি চায়। তাদের প্রধান দাবির মধ্যে রয়েছে – আলোচনা ব্যর্থ হলেও যেন যুদ্ধ আর নতুন করে শুরু না হয়। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে বলা হয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, যুদ্ধবিরতির জন্য ৬০ দিনের সময়সীমা সমন্বিত একটি প্রস্তাব ইসরায়েল ইতোমধ্যে মেনে নিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দুই পক্ষ স্থায়ী শান্তির পথে এগোবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ট্রাম্প হামাসকে উদ্দেশ করে বলেছেন, “এটাই তাদের জন্য সর্বোচ্চ সুযোগ। পরিস্থিতি এরপর আরও খারাপ হতে পারে। সময় এখনই।”
শান্তি প্রস্তাবের কাঠামো ও হামাসের সংশোধনী
সুবিধাসমূহ যা প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত: (1) ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে জিম্মি মুক্তি ও মরদেহ হস্তান্তর।
গাজায় জাতিসংঘ ও রেড ক্রসের মাধ্যমে ত্রাণ সরবরাহ।
(2) উত্তরের কিছু অংশসহ গাজার নির্দিষ্ট এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার।
হামাসের প্রধান সংশোধনী চাহিদাসমূহ: যুদ্ধবিরতি চুক্তি ব্যর্থ হলেও যেন ইসরায়েল নতুন করে হামলা শুরু না করে, এ বিষয়ে মার্কিন নিশ্চয়তা।
(1) ত্রাণ বিতরণ শুধুমাত্র জাতিসংঘ ও তাদের স্বীকৃত অংশীদারদের মাধ্যমে করতে হবে।
(2) যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত GHF (Gaza Humanitarian Foundation) ত্রাণ বিতরণ বন্ধ করতে হবে।
(3) ইসরায়েলি বাহিনী যেন মার্চে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব অবস্থানে সম্পূর্ণরূপে ফিরে যায়।
হামাসের প্রস্তাবনা পর্যালোচনার মাঝেই গাজা উপত্যকা জুড়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ১৩৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকায় আশ্রয়গ্রহণকারী শিবিরে হামলায় নিহত হন অন্তত ১৫ জন। নিহতদের মধ্যে ১৩ বছর বয়সী মায়ার আল-ফার এর ভাই মাহমুদের নাম রয়েছে।
রয়টার্সকে মায়ার বলেন— “যুদ্ধবিরতি আসতে চলেছে, অথচ তার আগেই আমার ভাই নেই! যুদ্ধ থেমে গেলে তাকে অন্তত হারাতে হতো না।”
শুধু আহত ও নিহত নয়, গাজায় ত্রাণ পাঠানো নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা।
রাফাহতে আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের এক কর্মী গুলিবিদ্ধ হন।
মেডসঁ সঁ ফ্রঁতিয়ের (MSF) জানায়, খান ইউনিসে খাদ্য সহায়তার লাইনে দাঁড়ানোয় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলি চালনায় অন্তত ১৬ জন নিহত।
জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর বলছে, GHF-এর বিতরণ এলাকায় ৬০০-র বেশি লোক নিহত।
ইসরায়েল সেনাবাহিনী এই অভিযোগের বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য না করে জানিয়েছে, তারা অভিযোগগুলো যাচাই করছে। তবে তারা GHF-সংক্রান্ত বড় ধরনের প্রাণহানির দাবিকে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেছে।
তেল আভিভে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে জিম্মিদের পরিবারের আয়োজিত সমাবেশে সমর্থনে হাজির হন বৃহৎ জনগোষ্ঠী।
তারা বিশাল ব্যানার বহন করেন—”সবার জন্য স্বাধীনতা”। এতে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ও আর্তনাদ: “চুক্তি করুন”।
ইসরায়েলি-আমেরিকান রুবি চেন, যিনি গাজায় জিম্মি হওয়া সেনা ইতাই চেনের বাবা, সমাবেশে বলেন—
“প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমন একটি চুক্তি নিয়ে ফিরে আসেন, যেখানে সব জিম্মি ঘরে ফিরতে পারে।”
নেতানিয়াহু বলেন, “আমার প্রথম কাজ—সব জিম্মিদের মুক্ত করা। এবং আমরা তা করব।” তবে নেতানিয়াহু আরও জানিয়েছেন, যুদ্ধ যতক্ষণ না হামাসের শাসন ও সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্ত যুদ্ধবিরতি হবে না।
যুদ্ধের পরিসংখ্যান ও ট্রাজেডির সূচনা: ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত ও ২৫১ জন জিম্মি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫৭,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি, যাদের একটি বৃহৎ অংশ নারী ও শিশু
মার্কিন-সমর্থিত প্রস্তাব নিয়ে হামাস আলোচনায় আশাবাদী হলেও তারা যদি তাদের চাওয়া সংশোধনীতে সমর্থন না পায়, তবে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
একদিকে চলছে শান্তিচুক্তির আলোচনা, অন্যদিকে গাজায় রক্তপাত বইছে থেমে থেমে—এই বৈপরীত্যেই এখন বন্দি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি সম্ভাবনা।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, UNHRC, MSF, Gaza Health Ministry